শেয়ার বাজারকে বুঝতে হলে এর দুটি অংশকে বোঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমটি প্রাইমারি, অর্থাৎ, যেখানে বিনিয়োগকারী সরাসরি কোম্পানি ম্যানেজমেন্টকে টাকা দেয়। এই টাকা কোম্পানির ম্যানেজমেন্ট সরাসরি বিনিয়োগ করে। পরবর্তী ক্ষেত্রে (সেকেন্ডারি) এই শেয়ারটি স্টক এক্সচেঞ্জ দ্বারা লিস্টিং হয় এবং এক বিনিয়োগকারী থেকে অন্য বিনিয়োগকারীর সঙ্গে হাতবদল হতে থাকে এবং শেয়ারের দাম ওঠানামা করে। এই বিনিয়োগ থেকে উদ্ভুত মুনাফা বা লোকসান বিনিয়োগকারীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, কোম্পানির ম্যানেজমেন্ট এর কোনও অংশ পায় না।
দেশ স্বাধীন হবার কয়েক মাস আগে (১৯৪৭ সালের ১৮ এপ্রিল) ‘ক্যাপিটাল ইস্যু কন্ট্রোল আইন’ তৈরি হয়। প্রাইমারি শেয়ার মার্কেট দেশের ক্যাপিটাল মার্কেটের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ– এই মার্কেটে সমস্ত লগ্নিপত্র প্রথমবারের জন্য লগ্নিকারীদের কাছে লগ্নির জন্য আনা হয়। লগ্নিকারীরা তাঁদের সঞ্চয় প্রাইমারি শেয়ার মার্কেটে লগ্নি করতে আসেন অনেক আশাভরসা নিয়ে। কিন্তু বেশির ভাগ লগ্নিকারীরা কিছু না জেনে শুধুই আশাভরসা করে টাকা ঢালেন। বলা হয়, আমাদের দেশে প্রাইমারি শেয়ার মার্কেট শুধুমাত্র বড় বড় সংস্থার জন্য তৈরি। আদতে তা কিন্তু নয়; ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পও এখন প্রাইমারি মার্কেটে এসে লগ্নির টাকা তুলতে পারে। এই প্রাইমারি মার্কেটে যে কোনও কোম্পানি ইনিসিয়াল পাবলিক অফার [আইপিও], অফার-ফর-সেল বা প্রাইভেট প্লেসমেন্ট নিয়ে আসতে পারে।
কোম্পানিগুলি প্রাইমারি মার্কেটে আসার আগে লগ্নিকারীদের জন্য প্রসপেক্টাস তৈরি করে। প্রসপেক্টাস এক কথায় একটি কোম্পানি সম্বন্ধে শ্বেতপত্র যা প্রকাশ করার আগে সব ডিরেক্টরদের সম্মতি ও সই লাগে। এই প্রসপেক্টাসে সব কিছুই লিখতে হয়, যেমন, কোম্পানির অতীত, বর্তমান ব্যবসা, কোম্পানির ঝুঁকি ও ভবিষ্যৎ। কোনও মিথ্যা কথা প্রসপেক্টাসে লিখলে তা কিন্তু এক কঠোর ফৌজদারি ও দেওয়ানি বিধিসম্মত আইনি অপরাধ। তাই, এই গুরুত্বপূর্ণ প্রসপেক্টাস ডকুমেন্ট সম্বন্ধে লগ্নিকারীদের ভালো ভাবে জানা উচিত। একজন সাধারণ লগ্নিকারী, যিনি বহু কষ্টে তাঁর সঞ্চিত টাকা লগ্নি করার আগে ওই প্রসপেক্টাসে ক্ষুদে ক্ষুদে অক্ষরে কী লিখিত আছে তা পড়বেন, বুঝবেন অথবা জানবেন কী করে? প্রসপেক্টাসে লিখিত তথ্যগুলি, একে দুরূহ আইনি ভাষায় তার ওপর এমন অত্যন্ত ক্ষুদ্র হরফে ছাপা হয় যে সেগুলি শুধু পড়ে মর্মোদ্ধার করা একজন সাধারণ লগ্নিকারীর পক্ষে সত্যি খুবই দুরূহ। যদিও ১৯৪৭ সাল থেকে এখন অবধি অনেক নতুন আইন, নিয়মকানুন লগ্নিকারীদের সুরক্ষার জন্য ধীরে ধীরে এসেছে। বহু ঘাত-প্রতিঘাত, দেশিয় ও আন্তর্জাতিক দুর্নীতির অভিজ্ঞতা- এসব থেকে লগ্নিকারীদের স্বার্থে সংশ্লিষ্ট আইন ও তার প্রণয়ন পদ্ধতিরও প্রচুর পরিবর্তন, সংশোধন ও পরিমার্জন হয়েছে। তবে একটা কথা বলা উচিত, আজ থেকে একশো বছর আগে ১৯২২ সালে প্রকাশিত রাজশেখর বসু’র বিখ্যাত ‘শ্রীশ্রী সিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড’এর মতো করে প্রসপেক্টাস এখন আর লেখা হয় না। তবে গণ্ডেরিরাম বাটপারিয়াদের একেবারেই যে বাজারে দেখা পাওয়া যায় না তা কিন্তু নয়, তাঁদের রূপ বদলেছে! দরকার হলে আজকাল ‘সেবি’কে সেই সব সমস্যা সামলানোর জন্য প্রাইমারি মার্কেটের আসরে নামতে হয়। তাই, প্রসপেক্টাস আগের থেকে অনেক স্ফীত হয়েছে, অধুনা বহু তথ্য ও বিশ্লেষণ দেওয়া হয়, কিন্তু আমাদের দেশের ছাপোষা সাধারণ জনগণ খুব একটা লগ্নি সংক্রান্ত ব্যাপারে কতখানি সুবিধা পেয়ে থাকেন সে প্রশ্নের উত্তর কিন্তু এক কথায় দেওয়া যায় না। ‘তেমন কিছুই আসলে হয়নি মশাই, বুঝলেন’- সেটা হয়তো বলা ঠিক উচিত হবে না! তবে এটাও ঠিক, বাস্তব জগতে লগ্নিকারীরা প্রাইমারি মার্কেটে এত কিছুর পরেও প্রায়শই হাত পুড়িয়ে ফেলেন।