সপ্ত ডিঙা ভাসাইলাম কালিদহের জলে। কথাটা ভাবলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে নদীর বুকে সাদা পাল তোলা নৌকার সারি এবং তাতে পণ্য সামগ্রী সহ ভাসমান বণিক সম্প্রদায়, যার অন্যতম উজ্জ্বল জোতিষ্ক চাঁদ সদাগর। ভারত ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্র তখন বাংলা। অর্থনীতির ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, সারা পৃথিবীর মোট উৎপাদনের ৩৫ শতাংশই তখন ভারতের হাতে। চাঁদ সদাগরের সময়টা ২০০ থেকে ৩০০ খৃষ্টাব্দ। কিন্তু প্রথম খৃষ্টাব্দ থেকে ১৭৩০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত সারা বিশ্বের শিল্প উৎপাদনের ২৫-৩৫ শতাংশ বরাবরই ছিল ভারতের হাতে। এই চাঁদ সদাগরের বংশধররাই পরবর্তী সময় সুবর্ণ বণিক, গন্ধ বণিক, কংস বণিক ইত্যাদি সম্প্রদায়ের মাধ্যমে আজও আমাদের চারপাশেই ছড়িয়ে আছে। এই বৈশ্য সম্প্রদায়ের হাত ধরেই বংশ পরম্পরায় চলে এসেছে প্রাচীন বাংলার শিল্প ও বাণিজ্য।
প্রাচীনকাল থেকেই অর্থের বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করত মূলত জৈন, মারোয়াড়ি, পাঞ্জাবের ক্ষত্রী সম্প্রদায়। বাংলার অর্থনীতির যে ঔজ্জ্বল্য মূলত ১৬০০ থেকে ১৭০০ শতাব্দীর মধ্যে আমরা পাই তার কেন্দ্রে ছিল জগৎ শেঠের মারোয়াড়ি পরিবার। বহু বিশেষজ্ঞদের মতে, জগৎ শেঠের সম্পদের বর্তমান মূল্য প্রায় ১০০০ বিলিয়ন পাউন্ড। আপনারা নজর করলে দেখবেন, প্রতিটি গ্রামেই কামারপাড়া, কুমোড়পাড়া, তাঁতীপাড়া এসবের নিদর্শন আজও পাওয়া যায় এবং প্রতিটি গ্রামের এই পাড়াগুলির সাথে তখন কিন্তু বেশ যোগসূত্র ছিল। ভারত থেকে বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য তখন মূলত রাস্তা সিল্ক রুট ও স্পাইস রুট। কাজেই যে পরিবারগুলি মূলত অর্থের ব্যবসা করত, স্বাভাবিক ভাবেই তাদের সাথে তৎকালীন রাজা-বাদশাদের এক নিবিড় যোগাযোগ ছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, জগৎ শেঠের পরিবার তৎকালীন রাজা, জমিদার এবং উদ্যোগপতিদের ঋণ দান করত। সেই সময় তো এখনকার মতো সংগঠিত ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি, তাই এই লগ্নীকারী সম্প্রদায়ের হাত ধরেই চলত রাজত্ব। ফলত, ঋণ নীতি, বিনিয়োগ, রাজকোষাগারের নীতি নির্ধারণে এই শ্রেণির মতামত রাজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে ছিল গুরুত্বপূর্ণ। বহু ক্ষেত্রেই রাজনীতির চোরাস্রোত বয়ে চলত এই শ্রেণির স্বার্থের উপর ভিত্তি করে। পলাশীর যুদ্ধও তার ব্যতিক্রম নয়।