বাঙালি ও শেয়ার বাজার

আড্ডার জন্য বাঙালির খ্যাতি সর্বজনবিদিত। আগের তুলনায় কমলেও দুই বা ততোধিক বাঙালি এক জায়গায় হলেই আড্ডা শুরু হয়ে যায়। আড্ডা চলতে পারে নানা বিষয় নিয়ে। তবে যে সব বিষয় প্রাধান্য পায় তার মধ্যে অবশ্যই থাকে রাজনীতি, সাহিত্য, সঙ্গীত, নাটক, সিনেমা, ফুটবল, ক্রিকেট এবং ভোজন। পরচর্চাও স্থান পায় বাঙালির আড্ডায়। ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যেতে পারে এইসব বিষয় নিয়ে আড্ডায়। যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে বাঙালির আড্ডায় খুব একটা ঢুকতে দেখা যায় না তা হল অর্থচর্চা। প্রকাশ্যে টাকাকড়ি নিয়ে আলোচনা বাঙালি বরাবরই এড়িয়ে চলেছে। অর্থচর্চাকে একরকম সংস্কৃতির পরিপন্থী বলেই মনে করা হয়। অতীতেও গড়পড়তা বাঙালিকে কখনই তেমনভাবে টাকার পেছনে ছুটতে দেখা যায় নি। দুধে ভাতেই মোটামুটি সন্তুষ্ট থাকত আম বাঙালি। শেয়ার বাজার তো অনেক দূরের কথা। ঝুঁকি এড়িয়ে চলা বঙ্গসন্তানেরা ব্যাঙ্ক-ডাকঘরের বাইরে পা বাড়ানোর কথা একরকম ভাবতই না। শেয়ার বাজারকে জুয়ার ঠেক এবং ঘোড়দৌড়ের সঙ্গে এক পঙক্তিতে বসানো হত। ষাটের দশকে অনেক সিনেমাতে শেয়ার বাজারকে সর্বস্বান্ত হওয়ার শ্রেষ্ঠ জায়গা হিসেবে দেখানো হত। অর্থাৎ, সব মিলিয়ে শেয়ারে লগ্নি সমাজে খুব একটা সম্মানজনক ব্যাপার ছিল না।

অথচ, এমনটা কিন্ত হওয়ার কথা ছিল না। ১৭৭২ থেকে ১৯১২ পর্যন্ত কলকাতাই ছিল ইংরেজ শাসিত ভারতের রাজধানী। সাহেবদের হাতে এই বাংলাতেই প্রথম শিল্প স্থাপন শুরু হয়। এই কলকাতা শহরেই স্থাপিত হয় ভারতের প্রথম শেয়ার বাজার। স্থাপিত হয় দেশের প্রথম বণিক সভা ‘বেঙ্গল চেম্বার অফ কমার্স’। কিন্ত গড়পড়তা বাঙালি না ভিড়েছিল ব্যবসায়ে না শেয়ার বাজারে। ইংরেজরা নিজেদের সুবিধার জন্যে বেশ কিছু বাঙালিকে ইংরেজি শিখিয়েছিল। এঁদেরকে সাহেবরা খাতা লেখা এবং অন্যান্য কিছু কাজে ব্যবহার করত। এইভাবে বাঙালিদের মধ্যে ধীরে ধীরে করণিক শ্রেণির জন্ম হল। মোটামুটি ভাল মাইনে এবং সাহেবদের সাথে গা ঘষাঘষির সুবাদে সমাজে কেরানিদের সম্মান এবং প্রতিপত্তি বাড়তে লাগল। আর কোনও সাহেব কোম্পানিতে কেউ বড়বাবু হলে তো আর কোনও কথাই নেই। মাটিতে একরকম পা’ই পড়ত না। ভাল কাজ করলে ছেলের চাকরিও বাঁধা ছিল। এই কারণে তৎকালীন বাঙালিদের একটি বড় শ্রেণির ধ্যানজ্ঞান ছিল যেন তেন উপায়ে একটি কেরানির চাকরি জোগাড় করা। তা হলেই জীবন একরকম ধন্য হয়ে যেত। এই পথে যা আয় হত তা দিয়ে তখনকার দিনে ভালভাবেই জীবন কেটে যেত। ফলে, এঁরা কখনই ব্যবসা বা শেয়ার বাজারের দিকে পা বাড়ান নি। হাতে পাকা চাকরি থাকলে খামোখা ঝুঁকির পথে কেন পা বাড়াবেন? অন্যেরা কৃষিকাজ, ছোট ব্যবসা, যজমানি এবং অন্যান্য নানা কাজে নিয়োজিত হতেন। এইভাবেই দিন কেটে যেত। খুব কম লোককেই বাড়তি আয়ের জন্যে এদিক ওদিক দৌড়ঝাঁপ করতে দেখা যেত।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!