‘লক্ষ্মী ছেলে’

‘লক্ষ্মী ছেলে’

অন্ধকারে প্রদীপের মতো

দেশ জুড়ে অদ্ভুত হাওয়া। সেই হাওয়ায় বাজার এখন খুব গরম। যখন-তখন যার-তার ‘ভাবাবেগে আঘাত’ ক্রমাগত লেগেই চলেছে। কথায় বলে, ‘ফুলের ঘায়ে মূর্ছা যাওয়া’। ব্যাপারটা কিছুটা যেন সে-রকমই দাঁড়িয়েছে। পান থেকে চুন খসলেই নানান মানুষের নানান ভাবাবেগ– এমনকি কিছু ক্ষেত্রে একেবারে আনকোরা ভাবাবেগ- এমনই আহত হচ্ছে যে ‘হা হতোস্মি’ বলে বসে পড়া দূরস্থান, প্রাচীন ডাকাত দলের মতো ‘হা-রে রে-রে’ অট্টহাস্যে দশদিক কাঁপিয়ে অনেকেই তেড়ে আসছেন। ব্যাপারটা প্রাথমিকভাবে হাস্যকর মনে হলেও আদতে ভয়ের, আশঙ্কার; আবার একইসঙ্গে ইতিবাচক প্রত্যাশারও।

বেশিরভাগেরই মতে, ‘ট্রেন্ড’ হিসাবে যদি এটা চলতেই থাকে, মানে চলতে-চলতে একদিন যদি উসেইন বোল্টের সক্ষমতা অর্জন করে ফেলে, তাহলে এ-দেশ অন্ধ-বোবা-কালাদের দেশে পরিণত হবে। অথচ ভেবে দেখলে এও বোঝা যায় যে, সমাজের প্রগতির জন্য ‘ভাবাবেগে আঘাত’ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি আয়ুধ। যাঁদের নিয়ে আমাদের গর্ব, অর্থাৎ রামমোহন, বিদ্যাসাগরের কথাই দৃষ্টান্ত হিসাবে ধরা যেতে পারে; তাঁরা আজ কেন প্রণম্য, কেন তাঁদের সমাজ-সংস্কারক কিংবদন্তির মর্যাদা দেওয়া হয়? কেননা, তাঁরা সেই যুগে মানুষের ‘ভাবাবেগে আঘাত’ দেওয়ার কাজটিই করেছিলেন। সতীদাহ প্রথা বন্ধ করা থেকে বাল্যবিবাহ রোধ, বিধবাবিবাহ চালু, নারী শিক্ষার জন্য দিকে-দিকে বিদ্যালয় খুলে দেওয়া ইত্যাদি সবই তো সে-যুগের আমজনতার ‘ভাবাবেগে আঘাত’ করেই করা সম্ভব হয়েছিল। তার জন্য রামমোহন-বিদ্যাসাগরদের কী-কী ঝড় পোয়াতে হয়েছিল সে-কথা বলাই বাহুল্য। তাঁদের জন্যই আজ একুশ শতকে অনেকটা খোলা-হাওয়ার উন্মুক্ত পরিবেশ বাঙালি পেয়েছে। ‘ভাবাবেগে ক্রমাগত আঘাত’ দেওয়া ছাড়া এটা সম্ভব হত না।

জানি না, কৌশিক গাঙ্গুলির নতুন ছবি ‘লক্ষ্মী ছেলে’ জনমনে শেষাবধি কী প্রভাব ফেলবে, তবে ‘ভাবাবেগে আঘাত’ না-হোক সামান্য খোঁচা যে অবশ্যই দেবে তা নিশ্চিত। এমনিতে বাংলা ছবির বাজার খারাপ। বাংলা কেন, হিন্দি-বলিউডি ছবিও মুখ থুবড়ে পড়েছে। ওটিটি’র দৌলতে বিদেশি সিরিজ আর দক্ষিণী ছবি বাজার মাত করে রেখেছে। বাঙালিত্বে সুড়সুড়ি দিয়ে বাংলা ছবি দেখার জন্য বাঙালিকে হলমুখি করার চেষ্টা প্রবল, তবুও কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। ‘লক্ষ্মী ছেলে’ হয়তো মোড় ঘোরাবে।
এ-ছবিতে সুপার-স্টার বলতে যা বোঝায় সেরকম প্রায় কেউই নেই, শ্যুটিং-এর লোকেশনও আহামরি কিছু নয়, আগমার্কা ঝাড়পিট নেই, ঝিনচ্যাক আইটেম-সং বা কোমর-দোলানোও নেই, মারকাটারি ভিএফএক্স নেই; অর্থাৎ, সব মিলিয়ে বিগ-বাজেট বিনিয়োগের মতো কিচ্ছুটি নয় এ-ছবি। বরং একেবারে উলটো পথের পথিক। এমন এক ছবি যা প্রচলিত জনমতকে তীব্র শ্লেষ করে– বলে, ধর্ম নয়, বিজ্ঞান– আরও গম্ভীর হয়ে জানায়, কুসংস্কার নয়, মানবতাই হল টিকে থাকার একমাত্র পন্থা। অন্ধবিশ্বাস, নির্বিচার ভক্তিকে পুঁজি করে যেখানে দু-পয়সা কামিয়ে নেওয়ার বাসনা কালো-মেঘের মতো ঘিরে ধরেছে গোটা সমাজকে, সেখানে এক টুকরো প্রদীপ হাতে ‘লক্ষ্মী ছেলে’ ‘অমরনাথ’ নয় ‘আমির হোসেন’ হাজির হয়, সঙ্গে পায় গায়ত্রী আর শিবনাথকেও। নির্মিত হয় কাহিনির শরীর যা সমাজের রক্ত-মাংস-মজ্জাকে আশ্রয় করে গড়ে তোলে আশ্চর্য এক ছবি। একে ছায়াছবি না বলে বরং কায়াছবিই বলা যাক। ঠাসবুনোটে গল্পকে কীভাবে জ্যান্ত করে তুলতে হয় তা কৌশিক গাঙ্গুলি দেখিয়েছেন আবারও। আর এটাই ছবিটির ইউএসপি, জনমুখে যা প্রচারিত হচ্ছে। এমন একটি সময়ে এমন একটি ছবি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে– বাণিজ্যিক দিক থেকেও, অগ্রসর দৃষ্টিভঙ্গিতেও।

এই ছবি সত্যিই আঁধারাচ্ছন্ন সময়ে প্রদীপ নিয়ে এসেছে। মনে পড়ে যায়, রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের ‘অন্ধকারকে অভিশাপ দেওয়ার চেয়ে…’ নিবন্ধটির কথা। কতদিন আগে পড়েছিলুম, অথচ আজও অমলিন। তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, ‘অন্ধকার কী?’ বলেছিলেন, ‘অন্ধকার তো সত্যিকারের কোনো জিনিস নয়। সে তো শুধু আলোর অভাব। যতই গাঢ় হোক, একটা জোনাকি উড়লেই ভয় কেটে যায়।’ এই ছবিও তাইই। হিংসা, অসহিষ্ণুতা, কুসংস্কার, দুর্নীতি, কণ্ঠরোধের অন্ধকার সময়ে একটি প্রদীপ। এ-কথা সত্য যে প্রদীপের শক্তি কতটুকু, কতখানিই বা আলো সে ছড়িয়ে দিতে পারে, সে-তো আর বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডকে আলোকিত করার ক্ষমতা রাখে না। তবুও বাঙালির জীবন যখন নবজাগরণের আলোয় আলোকিত হয়েছিল, তখন থেকে আজ অবধি কেটে গিয়েছে অনেকটা সময়। এখন বোধকরি সে-আলো কিছুটা নিষ্প্রভ হয়েছে। আজকাল আবার পেছন দিকে টানছে নরকের হাতগুলি। সেখানে দাঁড়িয়ে কৌশিক গাঙ্গুলির এই প্রদীপটিকে ক্ষুদ্র বলে দূরে ঠেলা যায় নাকি, বরং হাত দিয়ে আড়াল করে বিষাক্ত-হাওয়ার কবল থেকে বাঁচিয়ে রাখাই কর্তব্য। হোক না সে ক্ষুদ্র প্রয়াস, তবুও সেও তো এক নতুন শুরু। ‘আদিম মানুষ যদি সূর্যাস্তের পর হাত পা গুটিয়ে থাকত, শুধুই অপেক্ষা করত সূর্য ওঠার জন্য – তবে যে-তিমিরে সে ছিল, সেই তিমিরেই থেকে যেত। অন্ধকারকে জয় করার পথে প্রদীপ ছিল নেহাতই তুচ্ছ একটা ধাপ। অতটুকু আলো দিয়ে কতটুকু আঁধার কাটত? তবু সেই নগন্য সূচনাটুকুও না-হলে আমরা আজ কোথায় থাকতুম?’

তাই প্রশ্নগুলি উঠুক আবার নতুন করে। কুসংস্কারের সঙ্গে বিজ্ঞানের সংঘাত লাগুক। ভাবাবেগ আহত হয়ে শতচ্ছিন্ন হোক। মানুষ বরং নতুন প্রদীপের উষ্ণতার আশিস মাথায় ঠেকিয়ে নিক। মনে রাখতে হবে, দিনের শেষে মানুষই মানুষের শত্রু, আবার মানুষই তো মানুষের বন্ধুও। কোন্ হাত মানুষ বাড়াবে সেটা এবার মানুষকেই ঠিক করতে হবে। আমরা এইবারে দেরি না-করে ছবিটা বরং দেখেই আসি। আর কিছু না-হোক, এক অন্য রেশের স্পর্শ যে অবশ্যই লাগবে, তা গ্যারেন্টেড। কেননা এই বাজারে এমন ছবি আত্মশক্তির দোরে টোকা মারে যে!

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!