বন সংরক্ষণ বিধি ২০২২

বন সংরক্ষণ বিধি ২০২২

বন ও আদিবাসী জীবন ধ্বংসের আরও এক হাতিয়ার

কেন্দ্রীয় সরকারের পরিবেশ, বন ও আবহাওয়া পরিবর্তন মন্ত্রক গত ২৮ জুন সংসদের দুই কক্ষেই অনুমোদনের জন্য পেশ করেছে Forest Conservation Rules, 2022 [বন সংরক্ষণ বিধি, ২০২২] যা বর্তমান অধিবেশনেই পাশ হয়ে যাবে। এই বিধি এর আগে তৈরি ২০০৩’এর বিধি এবং ২০০৪, ২০১৪ ও ২০১৭-র পরবর্তী সংশোধনীগুলিকে প্রতিস্থাপন করবে। এই বিধি চালু হলে ভারতে বনাঞ্চল সংরক্ষণের জন্য যে রক্ষা কবচগুলি আছে তার সবগুলিকেই দুর্বল বা অক্ষম করে দেবে। সাফ কথা, যে মূল আইন Forest (Conservation) Act, 1980 [বন সংরক্ষণ আইন ১৯৮০]–এর আধারে এই বিধিগুলি তৈরি হয়েছিল, তার মূল উদ্দেশ্যের বিপরীতে এই নতুন বিধি তৈরি হয়েছে।

অন্যদিকে কেন্দ্রীয় সরকারেরই আর এক মন্ত্রক, আদিবাসী বিষয়ক মন্ত্রকের জারি করা আইন Scheduled Tribes and Other Traditional Forest Dwellers (Recognition of Forest Rights) Act, 2006 [চালু নাম– বনাধিকার আইন, ২০০৬] এবং তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিধিগুলির সম্পূর্ণ বিপরীতে ব্যবহৃত হবে এই নতুন বিধি। বনগ্রামের আদিবাসীদের তৈরি গ্রামসভাকে যেটুকু অধিকার অন্তত কাগজে কলমে দেওয়া হয়েছিল তার আর কোনও অর্থই রইল না। উক্ত আইনে দুটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকারের কথা বলা হয়েছিল- সম্প্রদায়গত অধিকার এবং পারিবারিক অধিকার। চিরাচরিত ভাবে যে সমস্ত বনবাসীরা বিভিন্ন বনগ্রামে বাস করে আসছেন এবং সম্প্রদায়গত ভাবে বনাঞ্চলের রক্ষণাবেক্ষণ এবং ভোগদখল করছেন, তাঁদের অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল এই আইন। সরকারের বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্ব ও কর্তব্যও নির্দিষ্ট করা হয়েছিল যাতে চিরাচরিত বনবাসীদের অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। আইনে বলা হয়েছে, গ্রাম স্তরে যাঁরা বসবাস করেন সেই প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাররা গ্রামসভা গঠন করবেন। এই গ্রামসভা স্তরেই গঠিত হবে বনাধিকার কমিটি। বনাধিকার আইন, ২০০৬-এ স্পষ্ট নির্দেশ ছিল, বনাঞ্চলের জমির চরিত্র যদি কোনও সাধারণের প্রয়োজনে বদলাতে হয়– যেমন স্কুল, হাসপাতাল, অঙ্গনওয়াড়ি, রেশন দোকান, ইলেকট্রিক লাইন, পুকুর খনন, জলের লাইন, প্রচলিত শক্তি কেন্দ্র, রাস্তা ইত্যাদি, তা গ্রামসভার উদ্যোগে করা যাবে। কোনও ব্যবসায়িক প্রকল্প, যেমন খনি, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পর্যটন ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট গ্রামসভার অনুমোদন ছাড়া করা যাবে না।

বনাঞ্চলের চরিত্র বদলাতে হলে বন সংরক্ষণ আইন, ১৯৮০-তেও নানা বিধি নিষেধ ছিল। এই বিধিনিষেধগুলি অবশ্য ক্রমশ হাল্কা করে দেবার প্রক্রিয়াও অব্যাহত ছিল। পরে কেন্দ্রীয় পরিবেশ ও বন মন্ত্রকের ২০০৯ সালের নির্দেশে বলা হয়, বনাঞ্চলে কোনও প্রকল্প চালু করতে হলে তা বনাধিকার আইনের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে করা বাধতামূলক হবে। ফলে, এই ধরনের প্রকল্পে গ্রামসভার অনুমোদন পাওয়া অন্যতম প্রাথমিক শর্ত ছিল। এই শর্ত লঙ্ঘন করার ফলেই উড়িষ্যায় নিয়মগিরি পাহাড়ে বেদান্ত লিমিটেড এবং উড়িষ্যা মাইনিং কর্পোরেশনের বক্সাইট উত্তোলন প্রকল্প ২০১৩ সালে সুপ্রিম কোর্টের  নির্দেশে বাতিল হয়ে যায়। ২০২২-এর এই বন সংরক্ষণ বিধির ফলে সেই রক্ষাকবচ আর থাকল না।

অবশ্য এই বিধি হঠাৎ আসেনি। এর আগেও ২০১৮ সালের জাতীয় বন নীতি, ২০১৯-এর ভারতীয় বন আইনের (Indian Forest Act) সংশোধনী এবং ২০২১-এর বন সংরক্ষণ আইনের (Forest Conservation Act) সংশোধনী সহ বিভিন্ন প্রস্তাব, নির্দেশ ও বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে দেশের বনাঞ্চলগুলিকে ব্যবসার স্বার্থে কর্পোরেটদের কাছে হস্তান্তরের ব্যবস্থা ধারাবাহিক ভাবে করা হয়েছে। ফলে, প্রতি বছরে বনাঞ্চল ধ্বংসের হার গড়ে ৬০০০ থেকে ১০,০০০ হেক্টরে পরিণত হয়েছে।   

২০২২-এর নতুন এই বন সংরক্ষণ বিধি অনুযায়ী, কোনও রাষ্ট্রায়ত্ত বা কর্পোরেট কোম্পানির কোনও মাইনিং বা বিদ্যুৎ অথবা অন্য কোনও ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে বনাঞ্চলের জমির প্রয়োজন হলে আগে কেন্দ্রীয় সরকার প্রকল্পর চূড়ান্ত অনুমোদন করবে। এই অনুমোদন পাবার পর রাজ্য সরকার বা কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলগুলির দায়িত্ব হবে- অন্যান্য সমস্ত আইন ও বিধি, এমনকি বনাধিকার আইন ও তৎসংক্রান্ত বিধিগুলিকে মান্যতা দিয়ে এবং কার্যকরী করে জঙ্গলের জমি লিজ দেবার বা তার চরিত্র পরিবর্তন করার অথবা বনাঞ্চলের সেই অংশকে সংরক্ষণের আওতা থেকে বার করে আনার। এই মর্মে রাজ্য সরকার নির্দেশ জারি করবে। অর্থাৎ, ইতিমধ্যেই কেন্দ্রিয় সরকারের চূড়ান্ত অনুমোদনের পর রাজ্য সরকার আবার তার অনুমোদন দেবে এবং বাকি আইনগুলি প্রয়োগের (যা একবার প্রকল্প অনুমোদন হয়ে গেলে কার্যকর করা অসম্ভব) দায় নেবে। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ, এই সমগ্র অনুমোদন থেকে প্রকল্প রূপায়ণের প্রক্রিয়ায় গ্রামসভার কোনও ভূমিকার কথাই উল্লেখ করা হয়নি; অর্থাৎ তা বাতিল করা হয়েছে। যদি রাজ্য সরকারগুলি বনাধিকার আইন প্রয়োগ করতেও চায় বা অন্যান্য আইনের মাধ্যমে বনাঞ্চল সুরক্ষিত রাখতেও চায়, তাহলেও তা করা সম্ভব হবে না। কেননা, ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদন দেওয়া হয়ে যাবে। ফলে, নিজের রাজ্যের আদিবাসী ও অন্যান্য চিরাচরিত বনবাসীদের সঙ্গে রাজ্য সরকারের বিরোধ তৈরি হবে।ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে বনাধিকার কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করেছেন যে কেন্দ্রীয় সরকারের পরিবেশ, বন ও আবহাওয়া পরিবর্তন মন্ত্রক (Ministry of Environment, Forest and Climate Change)-এর বিভিন্ন আইন এবং বিধির সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারেরই আদিবাসী বিষয়ক মন্ত্রকের (Ministry of Tribal Affairs)-এর আইন এবং বিধিগুলির সাযুজ্য না থাকায়, বনাধিকার কার্যকরী করা জটিল ও প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে তৃণমূল স্তরে প্রতিটি ক্ষেত্রে বন কর্মীদের কার্যকলাপের সঙ্গে আদিবাসীদের উদ্যোগের কোনও তালমিল থাকছে না। রাজ্যে রাজ্যে বন বিভাগের বাজেট, ক্ষমতা ও অধিকার অনেক বেশি হওয়ায় আদিবাসী উন্নয়ন বা ঐ জাতীয় দফতরগুলি কোনও গুরুত্বই পায় না। একমাত্র শাল পাতা, মধু ইত্যাদি কেনাবেচা ছাড়া বন পরিচালনায় তাদের অংশগ্রহণের কোনও সুযোগ নেই। এই সমস্যাগুলির সমাধানের উদ্দেশ্যে গত বছর (৬ জুলাই ২০২১) কেন্দ্রীয় পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন দফতর এবং কেন্দ্রীয় আদিবাসী বিষয়ক দফতর এই প্রথম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি যৌথ সার্কুলার প্রকাশ করে। বনাধিকার আইন ২০০৬ এবং তার বিধিগুলি কার্যকরী করার নির্দেশ দেওয়া হয় এবং তার জন্য বিভিন্ন পথনির্দেশ করা হয়। যদিও তাতেও বনবাসীরা বন দফতরের ক্ষমতা মুক্ত হয়ে বন পরিচালনায় অংশ নিতে পারেন কিনা তাতে বেশ কিছু সংশয় ছিল। তাহলেও সমস্ত রাজ্যের প্রধান সচিবকে চিঠি দিয়ে বাস্তব অবস্থা স্বীকার করা হয়- ‘যাদের এই আইনের সুযোগ সুবিধা প্রাপ্য তাঁদের সামুদায়িক অধিকার এবং বনগ্রামবাসীদের পারিবারিক ও চিরাচরিতভাবে ভোগ করে আসা জমির অধিকার বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই স্বীকৃত হয়নি।’ এই যৌথ সার্কুলারে বলা হয়, এই আইন কোনও ক্ষেত্রেই অস্পষ্ট নয় কিন্তু তা স্বত্ত্বেও যদি কোনও বিভ্রান্তির অবকাশ থাকে, রাজ্যগুলিকে বলা হয় তা নিয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের সঙ্গে আলোচনা করে যৌথভাবে মীমাংসা করার। এই যৌথ সার্কুলারেও বন বিভাগের প্রাধান্য অক্ষুণ্ণ থাকে, তা স্বত্ত্বেও বনাধিকার আইন প্রয়োগ করা যে বন বিভাগেরও দায়িত্ব, তার স্বীকৃতি মেলে। কিন্তু নতুন এই বন সংরক্ষণ বিধি ২০২২ সেই দায়িত্বকে আবার অস্বীকার করে বনাঞ্চলের সর্বময় কতৃত্ব বন বিভাগের উপরই ন্যস্ত করল।

এই বন সংরক্ষণ বিধি ২০২২-এ প্রস্তাব করা হয়েছে, ব্যবসায়িক প্রয়োজনে বনাঞ্চলের জমির চরিত্র পরিবর্তন করতে হলে ক্ষতিপূরণের জন্য নতুন বনাঞ্চল তৈরি করতে বনবাসীদের সামুদায়িক জমি এবং নষ্ট হয়ে যাওয়া বনাঞ্চলের জমি নিয়ে জমি ব্যঙ্ক তৈরি রাখতে হবে যাতে ব্যবসায়িক প্রকল্পগুলিকে দ্রুত ছাড়পত্র দেওয়া যায়। ফলে, ব্যবসায়িক প্রকল্পগুলির জন্য প্রস্তাবনা আসার আগেই জমি ব্যাঙ্ক তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাবে। বনাধিকার আইনের প্রয়োগ সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হবে। 

যে সমস্ত জাতীয় উদ্যান, স্যাংচুয়ারি, ব্যাঘ্র প্রকল্প থেকে গ্রামবাসীদের স্থানান্তর করার পর এখনও বনাঞ্চল তৈরি করা হয়নি, এই বন সংরক্ষণ বিধি ২০২২-এ বলা হচ্ছে যে নতুন প্রকল্প উদ্যোক্তারা সেই সমস্ত জায়গায় গাছ লাগিয়ে বনসৃজন করলে তা ঐ প্রস্তাবিত প্রকল্পের জন্য ক্ষতিপূরণমূলক বনসৃজনের স্বীকৃতি পাবে। অর্থাৎ, ইতিমধ্যেই যে সমস্ত এলাকায় বনসৃজনের জন্য বনগ্রামগুলিকে স্থানান্তর করা হয়েছিল, সেই সমস্ত এলাকার বনসৃজন নতুন প্রকল্পের ক্ষতিপূরণমূলক বনসৃজন হিসাবে স্বীকৃতি পাবে। এইভাবে বেসরকারি উদ্যোগ নতুন বনসৃজনের জন্য এলাকা চিহ্নিত করার দায়িত্ব এবং খরচ থেকে মুক্তি পাবে। এই ভাবে বনাঞ্চলের সম্প্রসারণও সীমাবদ্ধ হয়ে থাকবে বা বলা ভাল বনাঞ্চল সঙ্কুচিত হবার প্রবণতা অক্ষুণ্ণ থাকবে।

একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠেছে। বনাধিকার আইন অনুযায়ী গ্রামসভার সামুদায়িক এবং ব্যক্তিগত দায়িত্বগুলি নিষ্পত্তি হয় জেলা স্তরে। এই দাবি নিষ্পত্তির কোনও সময় সীমা নির্দিষ্ট নেই। অন্যদিকে বনাঞ্চলে বেসরকারি উদ্যোগে প্রকল্পগুলির ছাড়পত্র দেবার সময়সীমা নির্দিষ্ট আছে। বিশেষত নতুন বিধি অনুযায়ী কেন্দ্রীয় স্তরে প্রথম পর্যায়ের অনুমোদন পেয়ে গেলে রাজ্য বা জেলা স্তরের পরবর্তী পর্যায়ের অনুমোদন দেবার চাপ আরও বাড়বে। 

সমস্যা হল, সংসদের দুই কক্ষেই এই বিধি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় গৃহীত হবে। আদিবাসী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণে আপামর আদিবাসীর বঞ্চনার অবসান হবে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহের আর কোনও অবকাশ থাকে কী?

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!